হারানোর ভয়
– শুক্লা রায় চৌধুরী
বাথরুমের কল থেকে সারা সকাল টুপ টুপ করে জল পড়েই যাচ্ছে। মনের গভীরের সেই যে গোপন ক্ষতটা থেকে যেমন ক্ষরণ হয় ঠিক তেমন করেই। না আর এই ভর সন্ধ্যে পর্যন্ত শুয়ে না থেকে উঠে ঘরের লাইট জ্বালালাম। অন্ধকার ঘরটা সাদা আলোয় ভেসে যেতে শুরু করলো সাথে সাথেই।জীবনের সব অন্ধকার পর্যায়গুলো যদি ঠিক এমন করেই আলোয় ভাসানো যেত বেশ হত তবে! দূর এসব ছাইপাশ ভেবে কাজ নেই।দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। চেনা শহরের এই অচেনা রূপ দেখে মনটা আরও ভারাক্রান্ত হতে শুরু করলো। এখন প্রায় পৌনে সাতটা বাজে। বাড়ি ফিরতি মানুষের ভিড় উপচে পড়ার কথা রাস্তায়! কিন্তু এখন কেমন শ্মশানের নীরবতা নিয়ে একলা পড়ে আছে পিচ কালো রাস্তাটা। শরীরটা ক’দিন ধরে ভালো না। চুল ওঠা, পায়ের মাসেলে অসম্ভব ব্যথা; সাথে বমি ভাবটাও আরো বাড়েছে। এখন ছয় মাস চলছে আমার। এত নেগেটিভ চিন্তা আমার আর আমার ভিতরে বেড়ে ওঠা ছোট্ট প্রাণের জন্যও একদমই ঠিক না। নীপা খুব বকে আমাকে এই কারণে। আমি সত্যিই চাই না এসব ভাবতে কিন্তু কেন যে মাথায় চলে আসে? নীপা সকালে বেরোনোর আগে বললো কাল ডক্টরকে ফোন করবে বলবে আমার প্রব্লেমগুলোর কথা। এখন এই পরিস্থিতে ডক্টর চেম্বার করছেন না ঠিকই কিন্তু অসুবিধা হলে ফোনে জানাতে বলেছেন।আজকের রাতটা গেলে বাঁচা যায়। কাল সকাল সকাল নীপা ফিরলে ফোন করে সব অসুবিধার কথা জানাতে হবে ওনাকে। কিছু দিন ধরে সমস্যাগুলো বড্ড বাড়ছে আমার। ওহ্ নীপা কে? সেটাই তো বলা হলো না। নীপা আমার বোন, নাম করা কেমিস্ট। এখন এই কঠিন পরিস্থিতিতেও ওকে ল্যাবে যেতে হয়। ওর কাজটাই তো এমন। তাও আজকাল অল্টারনেট ডে করে যেতে পারছে। আমার বড্ড অহংকারের জায়গা ও। খুব খেয়াল রাখে আমার। কি খাবো, কি করবো সবটা। ও ছাড়া আমার কেই বা আছে। বাবা মা? তারা তো আমি ক্লাস এইটে পড়া কালীন গাড়ির দুর্ঘটনায় দুজনেই মারা যান। তখন নীপা ফোরে পড়ে। বাবা একটা কোম্পানির হেড সুপারভাইজার ছিলেন। তাই আমাদের টাকা পয়সার সম্যসা হয়নি তেমন কোনোদিনই। আমাদের এক দূর সম্পর্কের মাসি আমাদের কাছে থাকতেন, আমরা মিষ্টি মাসি বলতাম, মাসি আমাদের বড় করে। মিষ্টি মাসিও দুই বছর আগে ছাদে জামা কাপড় তুলতে গিয়ে স্ট্রোক হয়ে মারা যায়।আমরা টের পাই কলেজ থেকে ফিরে আসার পর। মাসি চলে যাওয়ার পর বড় একলা হয়ে গেছিলাম। তখনি আমার জীবনে আসে সেই মানুষ। মানুষ বলা বোধয় ঠিক হলো না! হ্যাঁ, নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিলাম অবিনাশকে। বিয়ের পর আমুল বদলে যেতে দেখলাম চোখের সামনে ভীষণ চেনা মানুষটাকে একটু একটু করে। রোজ রাতে শুরু করতো অমানবিক অত্যাচার। আবার নিজে পরে আদর করে কাছে ডেকে নিত।ওর যে মানসিক রোগ ছিল এটা আমি বুঝিনি। মার ধর করে আবার নিজে ওষুধ লাগিয়ে দিত। রাত বাড়লে এখনো আমার ত্রাস শুরু হয়। দেড় বছর সংসার করতে পারলাম, হয়তো বলা ভালো চেষ্টা করছিলাম সংসার করার। হাল ছেড়ে চলে আসার পর বুঝলাম আমার শরীরের মধ্যে বাড়ছে একটা ছোট্ট ভ্রূণ। নীপা চায়নি আমি ঐ অমানুষের চিহ্ন বহন করি। অনেক করে বোঝালাম ওকে। আমার জীবনে কি আছে আর।
যে আসছে ওকে নিয়ে বেঁচে থাকব বাকি জীবনটা। না হয় গানের স্কুল খুলবো। তাতে চলে যাবে মোটামুটি। আমার কথা বুঝবে না আমার ছোট্ট নীপা সে আবার হয় নাকি! মেনে নিল নীপা। এত কিছু বললাম আমার নামটাই বলা হলো না তো! আমি দীপা, মনিদিপা রায়।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে কখন একটা ঘোরের মত এসে গেছিল। সম্বিৎ ফিরলো মুঠোফোনটা বেজে ওঠায়। তাড়াহুড়ো করে লিভিং রুমের দিকে যেতে গিয়ে হোঁচট খেলাম। আবার সেই বাজে গন্ধটা। সারাদিন পাওয়া যায়না। তিন দিন হল দুপুরের পর থেকে বাড়তে থাকে। সহ্য করা যাচ্ছে না এই গন্ধ। না চাইতেও সোফার দিকে চোখ গেল।ফ্ল্যাশ ব্যাকের মত ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা ছবির মত একের পর এক উঠে আসতে শুরু করলো চোখের সামনে। সাতদিন আগে এরকমই এক সন্ধ্যে বেলায় তানপুরা নিয়ে বৃন্দাবনী সারং এর সুর নিয়ে খেলছিলাম।ঠিক তখনই ফোনটা আসে। ফোনের ও পাশ থেকে রোজের মত নীপা- “কি করছে আমার দিপু ডার্লিং? রেওয়াজ নিশ্চয়ই!”
-“তোর ফাজলামি আর গেল না? তুই আমাকে বড্ড বুঝিস রে সোনা।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম “ঘরবন্দি হয়ে আর ভালো লাগছে না; তাই গান নিয়ে বসলাম। বাইরে দাঁড়িয়ে অচেনা শহরটাকে দেখছিলাম রে। কি যে হয়ে গেল।”
-“বুঝতে পারি তোকে দিভাই কিন্তু তোর মতন করে বোঝাতে পারি না আমার কথাগুলো।” নীপা মাঝে মাঝে এমন কথা বলে আজকাল আমি বুঝি না। অনেক বড় হয়ে গেছে বোনটা।
স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই বলে ওঠে নীপা “হরলিক্স খেয়েছিস? “
আমি বললাম “তোকে বলছিলাম না হরলিক্সের টেস্টটা কেমন যেন রে? একদম খেতে ইচ্ছে করে না। তাও খেলাম জোর করেই। না হলে তোর বকুনি খেতে হবে যে।”
-“বেশি করে নিয়ে খা দেখবি ভালো লাগবে টেস্ট। তোর এমনিতেই কিছুই ভালো লাগে না আজকাল। আমাকেও লাগে না হয়তো” – অভিমানী সুরে বলে উঠলো নীপা।
-“কি যা তা বলছিস? তুই ছাড়া কে আছে আর? আচ্ছা শোন কাল ডক্টরকে ফোন করতে হবে। আমার প্রব্লেমগুলো খুব বাড়ছে রে। আর পারছিনা। হাঁপিয়ে যাচ্ছি গান করতে গিয়েও। এখন রাখছি পরে কথা বলছি।”
ফোনটা রেখে তানপুরা পাশে সরিয়ে রেখে কোনো রকমে টয়লেটে গিয়ে বমি করলাম। চোখে মুখে মাথায় জল দিলাম।টাওয়েল দিয়ে মুছতে গিয়ে দেখি এক দলা চুল উঠে এলো।বুকের পাশের চিনচিনে ব্যথাটা কেন যেন বাড়তে শুরু করছে। কোনো রকম গিয়ে শুয়ে পড়লাম ড্রয়িংরুমে রাখা সোফাটার উপর। কি অসহ্য কষ্ট হচ্ছে!কেন হচ্ছে এরকম। নীপাকে ফোন করে আসতে বলতে হবে। কোনো রকম ফোন নিয়ে ফোন করতে যাব নীপাই ফোন করলো।
-“নীপা খুবব কষ্ট হচ্ছে। তুইইই আয় প্লিজজজ। ডক্টরকে ফোন কর। আমি.. আমি আর পার….ছি না না।” ফিসফিসিয়ে বলে উঠলাম। নিজের গলা নিজেই চিনতে পারছিলাম না। ফোনের ওপাশ থেকে নীপা কেঁদে বলে উঠলো।
-“আমার খুব কষ্ট হয় দিভাই। তুই আমাকে কোনো দিন ভালোবাসিস নি। তাই তো আমার কথা না ভেবে ওই অবিনাশের কাছে ছুটে গেছিলি। আবার ওর দেওয়া বীজ নিয়ে ঘুরছিস। তাকে আনবি পৃথিবীতে? আবার আমাকে একা করে ওকে নিয়ে মেতে থাকবি। না আর সহ্য করতে পারবো না।তাই তো দুজনকেই একসাথে — “
-“তোর কথা কিছু বুঝতে পারছি না। আমার সামনে সব ঘোলা হয়ে আসছে তুই আয়” জানিনা কথা শুনতে পেল কিনা ফোনটা কেটে গেল।
হ্যাঁ, নীপা এসেছিল অনেক রাতে। সোফার উপর রাখা আমার নির্জীব শরীরটা ধরে পাগলের মত কাঁদলো। কি সব বলে যাচ্ছিল নিজের মনেই। প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না তখন। কিন্তু রোজ এই একই ছবি চলতে থাকে সন্ধ্যের পর থেকে আমার সামনে।এখন বুঝতে পারি সব ও কি বলছিল সেদিন। মুখস্থ হয়ে গেছে সব চিত্র নাট্যের মতই। হরলিক্সের মধ্যে থিলিয়াম সল্ট মিশিয়ে দিয়েছিল নীপা নিজের হাতে করে, যাতে আমি আর ভিতরের ছোট্ট প্রাণটা আসতে আসতে চির ঘুমে ঘুমিয়ে পড়তে পারি। এখন যা বিভীষিকাময় পরিস্থিতি বাইরে কেউ কারো খবর রাখে না। এর থেকে আর ভালো সময় হয় না। তাই আমি আছি কি নেই কে খবর রাখবে। যে রাখতো সেই তো নিজে হাতে করে শেষ করলো। কি একটা ক্যেমিকাল দিয়ে আমার শরীরটাকে রেখেছে যাতে তাড়াতাড়ি পচন না ধরে। অবিনাশকে নীপা পছন্দ করতো না বুঝতাম কিন্তু এত রাগ যে, ওর চিহ্ন মুছতে আমাকেই মুছে দিল! আমার জীবনে প্রথমে আবিনাশ আসাতে ও ভেবেছিল ওর জায়গা হারিয়েছে।কারণ মা বাবা যাওয়ার পর আমাকে আঁকড়েই বেড়ে উঠছিল ছোট্ট নীপা। আমিও বুঝিনি যে কখন অজান্তে ওকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম। অবিনাশ আসাতে আমার জীবন কেমন রঙিন হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। বুঝিনি সবটাই ভুল ছিল। তাই নীপাকে একা রেখেই বিয়ে করে নিয়েছিলাম মন্দিরে গিয়ে। বিয়ের প্রথম ছয় মাস খবরও নিইনি বোনটার। বিয়ের যে মোহ কাটতে সময় লেগেছিল ওই ছয়মাসই। বাকি দিনগুলো চেষ্টা করেছিলাম যদি সংসার করতে পারি। অবিনাশের ছিল টাকার লোভ আর বিকৃত চাহিদা। ওর কবল থেকে বাঁচতে নীপার কাছেই আবার ছুটে আসি। তখন নীপা অনেক আগলেছে আমাকে।অবিনাশের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাও ওই নিয়েছে। না হলে হয়তো ওই কটা দিনও বাঁচা হতো না আমার। কিন্তু যখন বুঝলো আমি মা হব আবার আমাকে হারানোর ভয়ে পাগল হয়েই হয়তো শেষ করে দিল ওর প্রিয় দিভাইকেই।
bes bhalo